প্রেস-স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শগুলো চিহ্নিত করে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে আফ্রিকার নামিবিয়ার উইন্ডহোয়েক শহরে ইউনেস্কো ও ইউএনডিপিআই-র যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ডিক্ল্যারেশন অব উইন্ডহোয়েক ঘোষণাটির মুসাবিদা হয়। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩ মে-কে বিশ্ব প্রেস-স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। আজ আমরা ১৬ দিন পর দিবসটি উদযাপন করছি।
প্রেস-স্বাধীনতা কিভাবে লঙ্ঘিত বা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং কোন কোন সাংবাদিক স্বীয় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বা কারাবরণ করেছেন- সেসব তথ্য জনগণকে জানানোও এই দিবস পালনের লক্ষ্য। এই দিনে প্রেস-স্বাধীনতা মূল্যায়ন, সরকারকে প্রেস-স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সাধারণ জনগণকে এ সম্বন্ধে সতর্কীকরণ এবং তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রেস-স্বাধীনতার প্রাসঙ্গিক আলোচনার বিষয় ও পেশাগত নৈতিকতার কথা মিডিয়া-পেশাজীবীদের মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করা, পেশাগত কর্তব্য করতে গিয়ে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের স্মরণ করা এবং প্রেস-স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ বা বিলুপ্ত করার প্রয়াসে যাঁরা শিকার হয়েছেন তাঁদের সহায়তাদান হচ্ছে ওই দিবস পালনের কর্মসূচি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায় যে ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৫৪টি, যেসব ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৮৮ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে ১০১ জন সাংবাদিকই নির্যাতিত হন সংবাদ প্রকাশের জের ধরে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন ১১০ জন সাংবাদিক। পাশাপাশি সরকারি দলের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ক্যাডার, সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ৮৯ জন সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের হাতে প্রত্যক্ষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭ জন সাংবাদিক।
গত বছর খুন হয়েছেন দুজন সাংবাদিক। এ বছরের গত চার মাসে মোট ৩২টি ঘটনায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৪ জন সাংবাদিক। নিজ বাসভবনে খুন হয়েছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি।
আজ সংবাদপত্র আমাদের সঙ্গ দেয়। অনেকের কাছে তা নিত্যসঙ্গী। অনেকের কাছে নিত্য অবশ্যপাঠ্য। সংবাদপত্র আমাদের কৌতূহল নিরসন ও বিনোদনের উৎস। পৃথিবীকে আমাদের কাছে নিয়ে আসে, আমাদের বোধগম্য করে তোলে। সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও সংবাদপত্র আজ নানা ধরনের উটকো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের পারিবারিক জ্যোতিষ, চিকিৎসক, গৃহশিক্ষক, বাজার সরকার, ফ্যাশনের উপদেষ্টা এবং রেসিপির পরামর্শদাতা। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা বেশ কিছু সৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্যদান, অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সাহায্য কামনা, এসিডদগ্ধদের সহায়তাদান এবং পরিবেশ রক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সমাজ ও সরকারের সহায়তায় নানা কাজ করছে আমাদের সংবাদপত্র। এখন রাজধানীর প্রেসক্লাব হচ্ছে এক অভিযোগ দাখিলের জায়গা এবং প্রতিকার প্রাপ্তির ভরসাস্থল। এর মধ্যে হুজুগে ভাগ যাই থাক দেশের লোকে সংবাদপত্রকে কী চোখে দেখে এবং তার কাছ থেকে কী আশা করে তার কিছু প্রতিফলন ঘটেছে।
কী, কেন, কখন, কিভাবে কোথায় আর কে- এসব রাজ্যের প্রশ্নের উত্তর মানুষ আজ খোঁজে সংবাদপত্রের পাতায়। প্রাত্যহিক আবশ্যিক পাঠের ক্ষেত্রে আজ ধর্মগ্রন্থের ওপরে সংবাদপত্র স্থান করে নিয়েছে। ইতিহাসের আঁচড়, লিখন ও প্রথম খসড়া আজ সংবাদপত্রের পাতায় বিধৃত। কেবল সংবাদপত্রের ওপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু ইতিহাস লেখা হয়েছে। আমাদের দেশে ইতিহাসের মালমসলা যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়নি। দেশে যত পত্রিকা প্রকাশিত হয় সরকারি মহাফেজখানায় বা কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে তার স্থান সঙ্কুলান হবে না। প্রেস ইনস্টিটিউট ও ইউনির্ভাসিটি গ্রান্টস কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সংবাদপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সব সংবাদপত্রের স্থান না হওয়ার কথা। আঞ্চলিক পত্রপত্রিকা- যার মূল্য দিতে আমরা ইতঃস্তত করি- সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য নিকটস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে 'ফালতু' কাগজ সংগ্রহ করে পরে দেখা যাবে তারও একটা মূল্য রয়েছে। এভাবে আমাদের অতীতচেতনা পুষ্টি লাভ করবে। আমি ২০০২ সালের বিশ্ব প্রেস-স্বাধীনতা দিবসে যা বলেছিলাম তার পুনরুক্তি করলাম।
আজ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে অনেক সময় মালিকের স্বাধীনতা মনে হয়। তবে সেই স্বাধীনতা আপেক্ষিক ও সীমিত। কোনো সংবাদপত্রের মালিকের পক্ষে সহজে সাংবাদিকদের ছাঁটাই করা যায় না। পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে একটি সংবাদপত্র বেশি দিন চলবে না। তথ্যাশ্রয়ী ও সত্যাশ্রয়ী সাংবাদিকের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, বলাবাহুল্য হয়রানি থেকে তাঁকে কেউ সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনাগণ্ডা পেতে সারাক্ষণ তাঁদের উচ্চকিত থাকতে হয়।
সংবাদপত্র আজ এক বড় বিনিয়োগক্ষেত্র। এখানে কেনাবেচা হয়। টাকার খেলাও হয়। হুমকিতে অনেক সময় পাতা নড়ে। সাংবাদিকদের যেমন কর্তৃপক্ষ খুশি রাখতে চায়, তেমনি সাংবাদিকরাও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তেমন খাসলত হলে একটি সংবাদপত্র একেবারে আশ্রিত বা পোষ্য হতে পারে। সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল। সাধারণভাবে বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে সরকার এক সময় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন ব্যক্তি-উদ্যোগের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি সংবাদপত্র মানসম্পন্ন না হয় তবে সরকারের বিজ্ঞাপন-দাক্ষিণ্য পেয়ে তা টিকতে পারবে না, পাঠকেরও মন পাবে না।
এখনো সম্পাদক বা প্রকাশকের একটা সরকারি বা সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান রয়েছে। এই সম্মানের আড়ালে তাঁরা কার কী স্বার্থ উদ্ধার করছেন, তা খুব কম পাঠকেরই জানার সুযোগ হয়। নব্বইয়ের পর থেকে এ দেশের জাতীয় ও ছাত্ররাজনীতির এক বিরাট অংশ সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে। আজ ঋণখেলাপি ও ভূমিদস্যু থেকে শুরু করে সামরিক-বেসামরিক নানা গোয়েন্দা সংস্থার অর্থ-সহায়তায় সংবাদপত্র প্রকাশনার অভিযোগ শোনা যায়। সংবাদপত্রে বিনিয়োগ বিত্তবানদের জন্য আজ এক আকর্ষণীয় মৃগয়া। সেই মৃগয়ার শিকারি অনেক সময় আশুপ্রাপ্তি, চমকসৃষ্টি কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ছাপার অক্ষরে কিছু প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না।
পুলিশ বিভাগ বা বিচার বিভাগের মতো যেসব জাতীয় প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে তার পেছনে স্বাধীন সংবাদপত্রের অবদান অনেকখানি। বিচারকালে বা তদন্তকালে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে, বলাবাহুল্য, তা আদালতে চূড়ান্ত রায়ের আগেই আলোচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আজকাল অপরাধ তদন্তকালে বিষয়ে কৌতূহলী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সংবাদে মনের মাধুরী বা বিষ মেশানোর পর লেখা হয়। শেষ পঙ্ক্তিতে বা পাদটীকায় বলা হয়, এ ব্যাপারে তদন্তকারীকে একাধিকবার টেলিফোন করেও সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হলো না।
ইরাক যুদ্ধের সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধরত সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় যে সাংবাদিকরা কাজ করেন, তাঁদের কাজকে embedded journalism বা প্রোথিত সাংবাদিকতা বলা হয়। বর্তমানকালের যুদ্ধে পারমাণবিক, বিজাণুবাহক বা রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্মুখে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কিছু সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কাছে ন্যূনতম সহযোগিতা আশা করে থাকেন। বেশির ভাগ সাংবাদিক মনে করেন, যুদ্ধের নিদারুণ ভয়াবহতা সত্ত্বেও যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় সাংবাদিকরা তাঁদের কর্তব্যকর্ম স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারবেন না। প্রাণঘাতী পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের নিজেদের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কর্মপন্থা আবিষ্কার করতে হবে।
সংবাদ মাধ্যমে পক্ষপাতবিহীন ঘটনার বর্ণনাই বস্তুনিষ্ঠ। বস্তুনিষ্ঠতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। যাঁরা সব সময় গণমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দেন, তাঁরা নিজেরা অনেক সময় বস্তুনিষ্ঠ থাকেন না। সংবাদ মাধ্যম সবার কাছ থেকে নসিহত পেয়ে থাকে। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শুধু বস্তুনিষ্ঠতার পরামর্শ নয়, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতারও নসিহত পেয়ে থাকে। আবার ক্ষমতালিপ্সু ও ক্ষমতাচ্যুতদের কাছ থেকে 'সাহসী সাংবাদিকতার' ডাক আসে। তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে। তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হতে সময় লাগবে। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে বিচার বিভাগের নির্দেশনার চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের তদারকি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে এবং হচ্ছে। কোনো নির্বাচিত সরকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতিমালা ও কর্মসূচিগুলো গণতান্ত্রিক সমানাধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ণ কি না, গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতার কর্তব্য হলো তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরা।
প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর কিছু দিন আগে প্রেস কমপ্লেন্টস কমিশনের চেয়ারম্যান লর্ড ওয়েকহ্যাম যেখানে ব্যক্তি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে তেমন সাতটি প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য সম্পাদকদের অনুরোধ করেন। অপরাধ উদ্ঘাটন, জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, জনগণকে বিভ্রান্ত না রেখে তাদের বরং অবহিত রাখার জনস্বার্থে, না নিছক জনসাধাণের কৌতূহল মেটানোর জন্য বিতর্কিত ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে? যদি জনস্বার্থ নিহিত থাকে তবে এমন অন্য কোনো বিকল্প প্রকাশভঙ্গি রয়েছে কি না যে ক্ষেত্রে গোপনীয়তার লঙ্ঘন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়? সংবাদ-কাহিনীর অংশ হিসেবে চোরাগোপ্তাভাবে তোলা এমন ফটো ব্যবহার কি করা হচ্ছে, যা গোপনীয়তার হানি করে এবং তা কি কেবলই কাহিনীর সচিত্র অলঙ্করণের জন্য, না জনস্বার্থে তা সরাসরি প্রকাশ করা প্রয়োজন ছিল? যদি কাহিনীটির সঙ্গে কোনো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে তবে অন্য কোনোভাবে তা প্রকাশ করা যায় কি না, যার ফলে যার গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তার নিরাপরাধ এবং অসহায় আত্মীয়-স্বজন, বিশেষ করে তার সন্তানাদির ওপর, সবচেয়ে কম বিরূপ প্রভাব পড়বে? জনসমক্ষে বিচরণ করেন বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন একজন জননায়কের সম্পর্কে কোনো কাহিনী প্রকাশ করতে গিয়ে কি বিবেচনা করা হয়েছে যে ব্যাপারটি অত্যন্ত অপরোক্ষ ও অনিকট এবং তা প্রকাশ করার ব্যাপারে কোনো জনস্বার্থ নিহিত নেই? একজন জননায়কের পুরনো বক্তব্য বা কর্মের সঙ্গে তাঁর বর্তমান জীবনের তুলনা করতে গিয়ে কি বিবেচনা করা হয়েছে যে সেই তুলনা ন্যায্য এবং পূর্বতন বক্তব্য বা কর্ম এমনই ইদানীন্তন যে জনস্বার্থে সে সম্পর্কে কাহিনী প্রকাশ করা যায়? একজনের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে পূর্বে যেখানে জনস্বার্থ নিহিত ছিল, সে সম্পর্কে পরে কোনো কাহিনী প্রকাশ করার আগে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো নতুন করে বিবেচনা করা হয়েছে কি যে তেমন কোনো জনস্বার্থের অজুহাত আর বিদ্যমান নেই? গভীর বিবেচনা করে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে। গরম গরম সংবাদ পরিবেশনে তা খেয়ালে থাকলে সবার জন্যই তা হবে মঙ্গলকর।
আমাদের দেশের যোগাযোগ মাধ্যম এক উচ্চাবচ বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করে আসছে। ১৯৭৪ সালে সংবাদপত্রের সংখ্যা নিদারুণভাবে সীমিত করা হয়। অনেক সময় সম্পাদকদের সেলফসেন্সর বা অবদমনের জন্যও সমস্যার সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশের গোড়ার দিকে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ করা হলে আমি একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিকে আমার মন্তব্য চিঠির আকারে পাঠিয়েছিলাম। চিঠিটি ছাপানো হয়নি। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় শক্রর সঙ্গে যোগসাজশের জন্য যখন ৪০ হাজার মামলা রুজু করা হয় তখন একটি ইংরেজি চিঠিতে মন্তব্য করি যে এমন করলে বিচারব্যবস্থার সব প্রণালী বন্ধ হয়ে যাবে এবং সরকারকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিকে চিঠিটা ছাপানো হয়নি। ১৯৮১ সালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বক্তব্য 'সৈনিকেরা ব্যারাকে ফিরে যাবে' একটি বিদেশি সাপ্তাহিক, মার্কিন মুলুকের নিউজউইক-এ কেবল প্রকাশিত হয়। ঢাকার প্রধান প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রে তখন সেনাবাহিনী প্রধানের সেনানিবাস থেকে সেনানিবাসে দৌড়ঝাঁপের কথা বেশ বড় করে ছাপায়। দেশের অসামরিক শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর মতকে বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়। এই কথাগুলো আমি ১৯৯৮ সালের ২৬ আগস্ট বলেছিলাম একটি সংবাদ এজেন্সির দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে।
দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মতোই সাংবাদিকরা প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত। কয়েক বছর আগে সাংবাদিকদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলতে গিয়ে বড় দুঃখে টিপু সুলতান বলেন, 'আমি আহত হওয়ার পর সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হয়ে যৌথ বিবৃতি দিতে ২১ দিন সময় লেগেছিল। আর হারুন অর রশিদ মারা যাওয়ার পর দিন বিবৃতি এসেছে। তবে পৃথক পৃথক বিবৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, জাতির বিবেক বলে দাবিদার সাংবাদিকরা দুই শিবিরে বিভক্ত। যতই দিন যাচ্ছে এই বিভক্তি যেন আরো প্রকট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ সারা বাংলাদেশই দুই শিবিরে বিভক্ত। ....সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোনো কর্মসূচি কিংবা যৌথ কোনো বিবৃতি আজও চোখে পড়েনি। সাংবাদিকদের বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ নিজেদেরই দেখতে হবে। সাংবাদিকরা দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে সুশীল সমাজও সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়াবে, এ আমার বিশ্বাস। ....আর সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে অন্তত সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হবে এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।'
কাক নির্যাতিত হলে সহমর্মী কাকেরা তার সমর্থনে চিৎকার করে। নির্যাতিত সাংবাদিক তাঁর স্বীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছ থেকে অনেক সময় কাকসদৃশ ব্যবহার পায় না। মানুষ-সাংবাদিকদের নানা টানাপড়েন রয়েছে। সে নিয়ে দুঃখ বা মাতম না করে নির্যাতিতের পাশে দাড়ানোই আমি শ্রেয়স্কর মনে করি।
অবস্থাদৃষ্টে কি মনে হয় অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে? সাংবাদিক-দম্পত্তি সাগর ও রুনির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবিতে গোষ্ঠীনির্বিশেষে সব সাংবাদিক একযোগে সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি তো নিতে পারছেন।
টগবগে তরুণ সমাজের কাছে সময়ের তাড়া বেশি। বৈদ্যুতিক মাধ্যম পরিবেশিত সংবাদ শোনা বা পড়ার পর তাদের উৎসাহ নেই কালো অক্ষরে সংবাদ পড়ার। কিচিরমিচির টুইটার থেকে গালভরা সব নাম ফেসবুক, ব্লগ, ইউটিউব ইত্যাদির প্রতি তাদের আকর্ষণ অনেক বেশি। পশ্চিমা জগতে বহু বছরের পুরনো বনেদি সংবাদপত্রকে ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে পাট গুটাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র দেখে মনে হচ্ছে, আর্থিকভাবে তা এখনো সহিসালামতে আছে।
একদিক থেকে বাংলাদেশ অনুসন্ধানী ও অন্তর্ভেদী রিপোর্টারের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। আইন-অপরাধ-তদন্তের জগতে, কর-শুল্কখাতে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার-অপব্যবহারে এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং বাজিকরদের তেলেসমাতি সংঘটিত হচ্ছে তা অবিশ্বাস্যরকমভাবে চাঞ্চল্যকর ও রোমহর্ষক। বাঁধাধরা তদন্তে এসব অনিয়মের উদ্ঘাটন করে শাসন বা বিচার করা কঠিন ব্যাপার। সাংবাদিকরা ক্বচিৎ সংবাদজগতের অপসংস্কৃতি, অশুভ প্রভাব, হুমকিধামকি, অপঅর্জন বা দুর্নীতি সম্পর্কে লিখে থাকেন। হিমবাহের শীর্ষদেশের কিছু কথা মাঝেমধ্যে প্রকাশ পায়। বেশির ভাগই তো অতল অন্ধকারে। আমরা কি এতই হতভাগা যে এক অস্বচ্ছ, তমসাচ্ছন্ন এবং প্রতিকারহীন অবস্থাকে নিয়তি হিসেবে আমাদের মেনেই নিতে হবে।
[১৯ মে, ২০১২ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'যাত্রী', 'বিসিডিজেসি', 'বিএনএনআরসি' ও 'ইউনেস্কো'র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত প্রধান অতিথি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান-এর বক্তব্য।]
প্রেস-স্বাধীনতা কিভাবে লঙ্ঘিত বা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং কোন কোন সাংবাদিক স্বীয় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বা কারাবরণ করেছেন- সেসব তথ্য জনগণকে জানানোও এই দিবস পালনের লক্ষ্য। এই দিনে প্রেস-স্বাধীনতা মূল্যায়ন, সরকারকে প্রেস-স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সাধারণ জনগণকে এ সম্বন্ধে সতর্কীকরণ এবং তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রেস-স্বাধীনতার প্রাসঙ্গিক আলোচনার বিষয় ও পেশাগত নৈতিকতার কথা মিডিয়া-পেশাজীবীদের মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করা, পেশাগত কর্তব্য করতে গিয়ে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের স্মরণ করা এবং প্রেস-স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ বা বিলুপ্ত করার প্রয়াসে যাঁরা শিকার হয়েছেন তাঁদের সহায়তাদান হচ্ছে ওই দিবস পালনের কর্মসূচি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায় যে ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৫৪টি, যেসব ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৮৮ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে ১০১ জন সাংবাদিকই নির্যাতিত হন সংবাদ প্রকাশের জের ধরে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন ১১০ জন সাংবাদিক। পাশাপাশি সরকারি দলের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ক্যাডার, সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ৮৯ জন সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের হাতে প্রত্যক্ষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭ জন সাংবাদিক।
গত বছর খুন হয়েছেন দুজন সাংবাদিক। এ বছরের গত চার মাসে মোট ৩২টি ঘটনায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৪ জন সাংবাদিক। নিজ বাসভবনে খুন হয়েছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি।
আজ সংবাদপত্র আমাদের সঙ্গ দেয়। অনেকের কাছে তা নিত্যসঙ্গী। অনেকের কাছে নিত্য অবশ্যপাঠ্য। সংবাদপত্র আমাদের কৌতূহল নিরসন ও বিনোদনের উৎস। পৃথিবীকে আমাদের কাছে নিয়ে আসে, আমাদের বোধগম্য করে তোলে। সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও সংবাদপত্র আজ নানা ধরনের উটকো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের পারিবারিক জ্যোতিষ, চিকিৎসক, গৃহশিক্ষক, বাজার সরকার, ফ্যাশনের উপদেষ্টা এবং রেসিপির পরামর্শদাতা। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা বেশ কিছু সৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্যদান, অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সাহায্য কামনা, এসিডদগ্ধদের সহায়তাদান এবং পরিবেশ রক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সমাজ ও সরকারের সহায়তায় নানা কাজ করছে আমাদের সংবাদপত্র। এখন রাজধানীর প্রেসক্লাব হচ্ছে এক অভিযোগ দাখিলের জায়গা এবং প্রতিকার প্রাপ্তির ভরসাস্থল। এর মধ্যে হুজুগে ভাগ যাই থাক দেশের লোকে সংবাদপত্রকে কী চোখে দেখে এবং তার কাছ থেকে কী আশা করে তার কিছু প্রতিফলন ঘটেছে।
কী, কেন, কখন, কিভাবে কোথায় আর কে- এসব রাজ্যের প্রশ্নের উত্তর মানুষ আজ খোঁজে সংবাদপত্রের পাতায়। প্রাত্যহিক আবশ্যিক পাঠের ক্ষেত্রে আজ ধর্মগ্রন্থের ওপরে সংবাদপত্র স্থান করে নিয়েছে। ইতিহাসের আঁচড়, লিখন ও প্রথম খসড়া আজ সংবাদপত্রের পাতায় বিধৃত। কেবল সংবাদপত্রের ওপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু ইতিহাস লেখা হয়েছে। আমাদের দেশে ইতিহাসের মালমসলা যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়নি। দেশে যত পত্রিকা প্রকাশিত হয় সরকারি মহাফেজখানায় বা কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে তার স্থান সঙ্কুলান হবে না। প্রেস ইনস্টিটিউট ও ইউনির্ভাসিটি গ্রান্টস কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সংবাদপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সব সংবাদপত্রের স্থান না হওয়ার কথা। আঞ্চলিক পত্রপত্রিকা- যার মূল্য দিতে আমরা ইতঃস্তত করি- সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য নিকটস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে 'ফালতু' কাগজ সংগ্রহ করে পরে দেখা যাবে তারও একটা মূল্য রয়েছে। এভাবে আমাদের অতীতচেতনা পুষ্টি লাভ করবে। আমি ২০০২ সালের বিশ্ব প্রেস-স্বাধীনতা দিবসে যা বলেছিলাম তার পুনরুক্তি করলাম।
আজ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে অনেক সময় মালিকের স্বাধীনতা মনে হয়। তবে সেই স্বাধীনতা আপেক্ষিক ও সীমিত। কোনো সংবাদপত্রের মালিকের পক্ষে সহজে সাংবাদিকদের ছাঁটাই করা যায় না। পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে একটি সংবাদপত্র বেশি দিন চলবে না। তথ্যাশ্রয়ী ও সত্যাশ্রয়ী সাংবাদিকের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, বলাবাহুল্য হয়রানি থেকে তাঁকে কেউ সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনাগণ্ডা পেতে সারাক্ষণ তাঁদের উচ্চকিত থাকতে হয়।
সংবাদপত্র আজ এক বড় বিনিয়োগক্ষেত্র। এখানে কেনাবেচা হয়। টাকার খেলাও হয়। হুমকিতে অনেক সময় পাতা নড়ে। সাংবাদিকদের যেমন কর্তৃপক্ষ খুশি রাখতে চায়, তেমনি সাংবাদিকরাও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তেমন খাসলত হলে একটি সংবাদপত্র একেবারে আশ্রিত বা পোষ্য হতে পারে। সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল। সাধারণভাবে বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে সরকার এক সময় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন ব্যক্তি-উদ্যোগের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি সংবাদপত্র মানসম্পন্ন না হয় তবে সরকারের বিজ্ঞাপন-দাক্ষিণ্য পেয়ে তা টিকতে পারবে না, পাঠকেরও মন পাবে না।
এখনো সম্পাদক বা প্রকাশকের একটা সরকারি বা সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান রয়েছে। এই সম্মানের আড়ালে তাঁরা কার কী স্বার্থ উদ্ধার করছেন, তা খুব কম পাঠকেরই জানার সুযোগ হয়। নব্বইয়ের পর থেকে এ দেশের জাতীয় ও ছাত্ররাজনীতির এক বিরাট অংশ সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে। আজ ঋণখেলাপি ও ভূমিদস্যু থেকে শুরু করে সামরিক-বেসামরিক নানা গোয়েন্দা সংস্থার অর্থ-সহায়তায় সংবাদপত্র প্রকাশনার অভিযোগ শোনা যায়। সংবাদপত্রে বিনিয়োগ বিত্তবানদের জন্য আজ এক আকর্ষণীয় মৃগয়া। সেই মৃগয়ার শিকারি অনেক সময় আশুপ্রাপ্তি, চমকসৃষ্টি কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ছাপার অক্ষরে কিছু প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না।
পুলিশ বিভাগ বা বিচার বিভাগের মতো যেসব জাতীয় প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে তার পেছনে স্বাধীন সংবাদপত্রের অবদান অনেকখানি। বিচারকালে বা তদন্তকালে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে, বলাবাহুল্য, তা আদালতে চূড়ান্ত রায়ের আগেই আলোচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আজকাল অপরাধ তদন্তকালে বিষয়ে কৌতূহলী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সংবাদে মনের মাধুরী বা বিষ মেশানোর পর লেখা হয়। শেষ পঙ্ক্তিতে বা পাদটীকায় বলা হয়, এ ব্যাপারে তদন্তকারীকে একাধিকবার টেলিফোন করেও সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হলো না।
ইরাক যুদ্ধের সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধরত সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় যে সাংবাদিকরা কাজ করেন, তাঁদের কাজকে embedded journalism বা প্রোথিত সাংবাদিকতা বলা হয়। বর্তমানকালের যুদ্ধে পারমাণবিক, বিজাণুবাহক বা রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্মুখে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কিছু সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কাছে ন্যূনতম সহযোগিতা আশা করে থাকেন। বেশির ভাগ সাংবাদিক মনে করেন, যুদ্ধের নিদারুণ ভয়াবহতা সত্ত্বেও যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় সাংবাদিকরা তাঁদের কর্তব্যকর্ম স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারবেন না। প্রাণঘাতী পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের নিজেদের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কর্মপন্থা আবিষ্কার করতে হবে।
সংবাদ মাধ্যমে পক্ষপাতবিহীন ঘটনার বর্ণনাই বস্তুনিষ্ঠ। বস্তুনিষ্ঠতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। যাঁরা সব সময় গণমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দেন, তাঁরা নিজেরা অনেক সময় বস্তুনিষ্ঠ থাকেন না। সংবাদ মাধ্যম সবার কাছ থেকে নসিহত পেয়ে থাকে। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শুধু বস্তুনিষ্ঠতার পরামর্শ নয়, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতারও নসিহত পেয়ে থাকে। আবার ক্ষমতালিপ্সু ও ক্ষমতাচ্যুতদের কাছ থেকে 'সাহসী সাংবাদিকতার' ডাক আসে। তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে। তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হতে সময় লাগবে। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে বিচার বিভাগের নির্দেশনার চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের তদারকি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে এবং হচ্ছে। কোনো নির্বাচিত সরকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতিমালা ও কর্মসূচিগুলো গণতান্ত্রিক সমানাধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ণ কি না, গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতার কর্তব্য হলো তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরা।
প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর কিছু দিন আগে প্রেস কমপ্লেন্টস কমিশনের চেয়ারম্যান লর্ড ওয়েকহ্যাম যেখানে ব্যক্তি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে তেমন সাতটি প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য সম্পাদকদের অনুরোধ করেন। অপরাধ উদ্ঘাটন, জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, জনগণকে বিভ্রান্ত না রেখে তাদের বরং অবহিত রাখার জনস্বার্থে, না নিছক জনসাধাণের কৌতূহল মেটানোর জন্য বিতর্কিত ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে? যদি জনস্বার্থ নিহিত থাকে তবে এমন অন্য কোনো বিকল্প প্রকাশভঙ্গি রয়েছে কি না যে ক্ষেত্রে গোপনীয়তার লঙ্ঘন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়? সংবাদ-কাহিনীর অংশ হিসেবে চোরাগোপ্তাভাবে তোলা এমন ফটো ব্যবহার কি করা হচ্ছে, যা গোপনীয়তার হানি করে এবং তা কি কেবলই কাহিনীর সচিত্র অলঙ্করণের জন্য, না জনস্বার্থে তা সরাসরি প্রকাশ করা প্রয়োজন ছিল? যদি কাহিনীটির সঙ্গে কোনো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে তবে অন্য কোনোভাবে তা প্রকাশ করা যায় কি না, যার ফলে যার গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তার নিরাপরাধ এবং অসহায় আত্মীয়-স্বজন, বিশেষ করে তার সন্তানাদির ওপর, সবচেয়ে কম বিরূপ প্রভাব পড়বে? জনসমক্ষে বিচরণ করেন বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন একজন জননায়কের সম্পর্কে কোনো কাহিনী প্রকাশ করতে গিয়ে কি বিবেচনা করা হয়েছে যে ব্যাপারটি অত্যন্ত অপরোক্ষ ও অনিকট এবং তা প্রকাশ করার ব্যাপারে কোনো জনস্বার্থ নিহিত নেই? একজন জননায়কের পুরনো বক্তব্য বা কর্মের সঙ্গে তাঁর বর্তমান জীবনের তুলনা করতে গিয়ে কি বিবেচনা করা হয়েছে যে সেই তুলনা ন্যায্য এবং পূর্বতন বক্তব্য বা কর্ম এমনই ইদানীন্তন যে জনস্বার্থে সে সম্পর্কে কাহিনী প্রকাশ করা যায়? একজনের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে পূর্বে যেখানে জনস্বার্থ নিহিত ছিল, সে সম্পর্কে পরে কোনো কাহিনী প্রকাশ করার আগে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো নতুন করে বিবেচনা করা হয়েছে কি যে তেমন কোনো জনস্বার্থের অজুহাত আর বিদ্যমান নেই? গভীর বিবেচনা করে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে। গরম গরম সংবাদ পরিবেশনে তা খেয়ালে থাকলে সবার জন্যই তা হবে মঙ্গলকর।
আমাদের দেশের যোগাযোগ মাধ্যম এক উচ্চাবচ বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করে আসছে। ১৯৭৪ সালে সংবাদপত্রের সংখ্যা নিদারুণভাবে সীমিত করা হয়। অনেক সময় সম্পাদকদের সেলফসেন্সর বা অবদমনের জন্যও সমস্যার সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশের গোড়ার দিকে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ করা হলে আমি একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিকে আমার মন্তব্য চিঠির আকারে পাঠিয়েছিলাম। চিঠিটি ছাপানো হয়নি। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় শক্রর সঙ্গে যোগসাজশের জন্য যখন ৪০ হাজার মামলা রুজু করা হয় তখন একটি ইংরেজি চিঠিতে মন্তব্য করি যে এমন করলে বিচারব্যবস্থার সব প্রণালী বন্ধ হয়ে যাবে এবং সরকারকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিকে চিঠিটা ছাপানো হয়নি। ১৯৮১ সালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বক্তব্য 'সৈনিকেরা ব্যারাকে ফিরে যাবে' একটি বিদেশি সাপ্তাহিক, মার্কিন মুলুকের নিউজউইক-এ কেবল প্রকাশিত হয়। ঢাকার প্রধান প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রে তখন সেনাবাহিনী প্রধানের সেনানিবাস থেকে সেনানিবাসে দৌড়ঝাঁপের কথা বেশ বড় করে ছাপায়। দেশের অসামরিক শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর মতকে বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়। এই কথাগুলো আমি ১৯৯৮ সালের ২৬ আগস্ট বলেছিলাম একটি সংবাদ এজেন্সির দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে।
দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মতোই সাংবাদিকরা প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত। কয়েক বছর আগে সাংবাদিকদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলতে গিয়ে বড় দুঃখে টিপু সুলতান বলেন, 'আমি আহত হওয়ার পর সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হয়ে যৌথ বিবৃতি দিতে ২১ দিন সময় লেগেছিল। আর হারুন অর রশিদ মারা যাওয়ার পর দিন বিবৃতি এসেছে। তবে পৃথক পৃথক বিবৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, জাতির বিবেক বলে দাবিদার সাংবাদিকরা দুই শিবিরে বিভক্ত। যতই দিন যাচ্ছে এই বিভক্তি যেন আরো প্রকট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ সারা বাংলাদেশই দুই শিবিরে বিভক্ত। ....সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোনো কর্মসূচি কিংবা যৌথ কোনো বিবৃতি আজও চোখে পড়েনি। সাংবাদিকদের বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ নিজেদেরই দেখতে হবে। সাংবাদিকরা দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে সুশীল সমাজও সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়াবে, এ আমার বিশ্বাস। ....আর সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে অন্তত সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হবে এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।'
কাক নির্যাতিত হলে সহমর্মী কাকেরা তার সমর্থনে চিৎকার করে। নির্যাতিত সাংবাদিক তাঁর স্বীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছ থেকে অনেক সময় কাকসদৃশ ব্যবহার পায় না। মানুষ-সাংবাদিকদের নানা টানাপড়েন রয়েছে। সে নিয়ে দুঃখ বা মাতম না করে নির্যাতিতের পাশে দাড়ানোই আমি শ্রেয়স্কর মনে করি।
অবস্থাদৃষ্টে কি মনে হয় অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে? সাংবাদিক-দম্পত্তি সাগর ও রুনির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবিতে গোষ্ঠীনির্বিশেষে সব সাংবাদিক একযোগে সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি তো নিতে পারছেন।
টগবগে তরুণ সমাজের কাছে সময়ের তাড়া বেশি। বৈদ্যুতিক মাধ্যম পরিবেশিত সংবাদ শোনা বা পড়ার পর তাদের উৎসাহ নেই কালো অক্ষরে সংবাদ পড়ার। কিচিরমিচির টুইটার থেকে গালভরা সব নাম ফেসবুক, ব্লগ, ইউটিউব ইত্যাদির প্রতি তাদের আকর্ষণ অনেক বেশি। পশ্চিমা জগতে বহু বছরের পুরনো বনেদি সংবাদপত্রকে ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে পাট গুটাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র দেখে মনে হচ্ছে, আর্থিকভাবে তা এখনো সহিসালামতে আছে।
একদিক থেকে বাংলাদেশ অনুসন্ধানী ও অন্তর্ভেদী রিপোর্টারের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। আইন-অপরাধ-তদন্তের জগতে, কর-শুল্কখাতে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার-অপব্যবহারে এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং বাজিকরদের তেলেসমাতি সংঘটিত হচ্ছে তা অবিশ্বাস্যরকমভাবে চাঞ্চল্যকর ও রোমহর্ষক। বাঁধাধরা তদন্তে এসব অনিয়মের উদ্ঘাটন করে শাসন বা বিচার করা কঠিন ব্যাপার। সাংবাদিকরা ক্বচিৎ সংবাদজগতের অপসংস্কৃতি, অশুভ প্রভাব, হুমকিধামকি, অপঅর্জন বা দুর্নীতি সম্পর্কে লিখে থাকেন। হিমবাহের শীর্ষদেশের কিছু কথা মাঝেমধ্যে প্রকাশ পায়। বেশির ভাগই তো অতল অন্ধকারে। আমরা কি এতই হতভাগা যে এক অস্বচ্ছ, তমসাচ্ছন্ন এবং প্রতিকারহীন অবস্থাকে নিয়তি হিসেবে আমাদের মেনেই নিতে হবে।
[১৯ মে, ২০১২ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'যাত্রী', 'বিসিডিজেসি', 'বিএনএনআরসি' ও 'ইউনেস্কো'র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত প্রধান অতিথি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান-এর বক্তব্য।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন