মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মাতৃভাষার পক্ষে
নাম ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ আদমকে বিভিন্ন জিনিসের নাম শিখিয়েছিলেন। আগুনের তৈরি ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা শয়তান মাটির তৈরি আদিপুরুষ আদমের কাছে নামের খেলায় হেরেছিলেন। তারপরেও নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের অপরাধে আদমকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিলো। কারো মনে কোনো বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে ধারণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই বস্তুর একটি অবয়ব তিনি দেখতে পান, বোধ করেন বস্তু সংশ্লিষ্ট শব্দঝংকার।ঋকবেদে বলা হয়েছে, “মাতৃভূমি, নিজের সংস্কৃতি ও মাতৃভাষার প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধা রাখা উচিত। কারণ সেগুলো আনন্দ দেয়।”
অথর্ববেদে বলা আছে, “মাতৃভাষা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিও না। আমরা যেনো সবসময় মাতৃভাষার সেবা করতে পারি। যারা সৃষ্টিকর্তার গুণগান করতে চান তারা মাতৃভাষায় প্রার্থনা করুন। মাতৃভাষায়ই শুদ্ধতা ও সঠিকতার চর্চা করা যায়। মাতৃভাষার প্রতিটি শব্দ আমাদের রক্তের বাঁধনে বাধা। মাতৃভাষার প্রতিটি শব্দ দিয়ে মনের মতো অর্থের প্রকাশ ঘটে। প্রতিটি ‘মহান কলা’ই মাতৃভাষায় শিল্পীত হয়। মাতৃভাষায় আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন ও তার গুণকীর্তন করতে পারি।”
বাইবেলে নূহের উত্তরাধিকাররা ব্যবিলোনিয়ার শিনারের সমতল ভূমিতে স্বর্গারোহণের জন্য মিনার নির্মাণ করতে যান। তখন শব্দের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তাদের বিভ্রান্ত করেন ও পৃথিবীব্যাপী তাদেরকে ছড়িয়ে দেন।
কোরআনে বলা আছে, “ধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরিত প্রতিটি পুরুষ কেবল নিজের লোকজনের ভাষায় কথা বলেন যাতে তিনি ধর্মের বাণী স্পষ্ট করে তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেন।” (১৪ আব্রাহাম: ৪)
সেখানে আরো বলা হয়, “তার অন্যান্য প্রতীকের মধ্যে আছে স্বর্গ ও মর্ত্যের সৃষ্টি এবং আমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এ প্রতীকগুলো সব মানুষের জন্য।” (৩০ গ্রীক: ২২)
একটি ভাষা কেবল বলা ও লেখার জন্য নয়। কোনো ভাষার কাজগুলো সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য সেটিকে অবশ্যই লিখিত ও পঠিত হতে হবে। চীনারা তাদের লোগোগ্রাফের প্রতি খুব উৎসাহী এবং এর জন্য তারা গর্বিত। ছয় মাস আগে চীন সফরের সময় আমি চীনা ভাষার স্তুতিমূলক একটি কবিতা চেয়েছিলাম। আসার সময় আমাকে দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে তিনটি কবিতা। ঢাকায় আমার চীনা ভাষার শিক্ষক আমাকে আরেকটি কবিতা দেন। সেগুলোর সবকয়টিই চাইনিজ লোগোগ্রাফের প্রশংসামূলক। এটাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বয়সী ও রক্ষণশীল অনেক চীনাই এখনো চাইনিজ লোগোগ্রাফের আদি রূপের প্রতি বেশি আগ্রহী।
একটি ভাষা কেবল পড়া, লেখা ও হিসাব কষার জন্য নয়। চীনা কবি লু চির (২৬১-৩০৩) মতে তার আরো অনেক ব্যবহার আছে। চি বলেন, “লেখকের আনন্দই সব জ্ঞানী লোকের আনন্দ। প্রাণ না থাকলে ঘটে প্রাণের জন্ম; নীরবতার বাইরে কবি দেন গানের জন্ম।”
ফ্লোরা অরিমা-দেভাতিন নিজের লোকদের প্রতি আহ্বান জানান নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে (যেগুলোর ওপর তাদের জীবন নির্ভর করে) লিখিত রূপে সংরক্ষণ করার জন্য।
সাওতাল অলচিক পান্ডুলিপির আবিষ্কারক পণ্ডিত রঘু নাথ তার মান্ত্রা কবিতায় বলেন, “আপনার পাণ্ডুলিপি থাকলে আপনার ভাষা বেঁচে থাকবে। আপনার ধর্ম যতোদিন বেঁচে আছে ততোদিন আপনি বেঁচে থাকবেন। পাণ্ডুলিপি, ভাষা ও ধর্ম হারালে আপনিও হারিয়ে যাবেন।”
অ্যান্তোনিও জ্যাকিন্তোসের কবিতা ‘লেটার ফ্রোম অ্যা কনট্রাক্ট ওয়ার্কার’-এ দেখানো হয়েছে লেখা-পড়া না জানা মানুষের কষ্ট।
মানুষ ভাষায় অলৌকিকত্ব আরোপ করে। মানুষ প্রতিলিপি, ধারকলিপি, শব্দলিপি এবং বর্ণ আবিষ্কার করে। আমাদের যেসব আদিবাসীর কোনো পাণ্ডুলিপি নেই তারা গারোদের খুব পছন্দ করে।
ভাষা একটি মহান শক্তি। প্রত্যেক শাসক চান জনগণ তার ভাষা ব্যবহার করুক ও তার ধর্ম অনুসরণ করুক। নিষিদ্ধ ভাষা ব্যবহারের অপরাধে মানুষের জিহ্বা কেটে নেওয়ার বিধান দেয় কর্তৃত্ববাদী শাসকগণ। বিপরীতদিকে পবিত্র ভাষায় কথা বলা বা তা শোনার অপরাধে মানুষকে সাজা দেওয়া হয়। শুদ্র বা অস্পৃশ্যরা সংস্কৃত বেদ শুনলে তাদের কান সীসা দিয়ে আটকে দেওয়ার বিধান রয়েছে হিন্দুদের মধ্যে।
কোনো ভাষিক গোষ্ঠীকে যদি বারবার বলা হয় যে, তাদের ভাষা অপর্যাপ্ত বা অশ্লীল তখন তারা সংবেদনশীল মানুষ হলে মাতৃভাষা বিস্মৃত হয়ে একটি নতুন ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষা আয়ত্ত্ব করে থাকে। তারপরেও কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন। যেমন ফ্রানজ ফ্যানোন বলেন, “ফরাসি জনগোষ্ঠীর চেয়ে নিজেদের দুর্বল ভাবে না ব্রিটানিরা। শেতাঙ্গদের মাধ্যমে ব্রিটানিরা সভ্য হয়নি।”
কোনো মাতৃভাষা নেই, কেবল প্রথম (ফার্স্ট) ভাষা আছে-এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে লুই জ্য ক্যালভেট বলেন, প্রথম (ফার্স্ট) ভাষার বর্ণনায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির অধিকাংশই একই ধরনের রুপকল্প ব্যবহার করে। ফরাসিতে ল্যাঙ্গুয়ে ম্যাটেরনালে, স্প্যানিসে লিঙ্গুয়া ম্যাটেরনা, ইতালিয়ানে ইদিওমা ম্যাটেরনা, জার্মানে মুত্তেরস্প্রাচে ইত্যাদি। রুশ ভাষায় মাতৃভাষা ধারণার সঙ্গে জন্মের স্বতঃস্ফূর্ত যোগ রয়েছে। আফ্রিকার ভাষাগুলোতে মাতৃভাষাকে নানাভাবে বোঝানো হয়ে থাকে। দুধ, স্তন, স্তন্যপায়ী শিশু ইত্যাদি প্রত্যয় দিয়ে বোঝানো হয় প্রথম (ফার্স্ট) বা মাতৃভাষাকে। অপরদিকে, কিছু ভাষায় এমন ধারণা পাওয়া যায় যে, পৃথিবীর সঙ্গে মাতৃভাষার সম্পর্ক রয়েছে। চীনা ভাষায় মাতৃভাষা বলতে বোঝায়, “জাতির আদি ভাষা।”
মাতৃভাষার বন্দনা করে প্রায় প্রতিটি ভাষায় অনেক প্রবাদ রয়েছে। একটি গুয়ারানি (প্যারাগুয়ে) প্রবাদে বলা হয়, “গুয়ারানি শেষ হলে কে প্রার্থনা করবে, তাই এ শব্দটি হারিয়ে যেতে পারে না।”
অস্ট্রেলিয়ার নুনগা জনগোষ্ঠীর একটি আদিবাসী গানে বলা হয়, “আমি নুনগা এবং আমি তাতে গর্বিত। এটা আমাদের, নিজেদের নাম ধরে ডাকতে ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এটা আমাদের নিজস্ব ভাষা, তুমি কখনো এটাকে দূরে সরাতে পারবে না।”
আইনু (জাপান) লেখক ও লোকাচারবেত্তা মুতসুমি ইয়োকিয়োআমা বলেন, “আইনুর ভূমি মোশিরি ছেড়েছি আমি। সেখানে জীবন ছিলো কঠিন। কিন্তু তারপরে আমি আইনু ভাষার কথা ভাবতে থাকি। আমি আইনু জনগোষ্ঠীর একজন। আমি আমার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অনুভব করি। আমি বুঝতে পারি আইনু ভাষা আইনু জাতিগোষ্ঠীর জীবন ব্যবস্থাকে ফুটিয়ে তোলে এবং জানি যে, এ সমৃদ্ধ ভাষায় আমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমি এখন এ সত্য সম্পর্কে খুবই অবগত, আইনু অর্থ হচ্ছে ‘মানুষ’।”
পর্তুগীজ কবি ফার্নাদো পেসোয়া বলেন, “আমার মাতৃভূমি হলো পর্তুগীজ ভাষা।”
ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশ বলেন, তার দেশ সৃষ্টি হয়েছে ‘লানা বালেদ মিন কালাম’ শব্দগুচ্ছ থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে আন্না আখমাতোভা ‘কারিজ’ নামের একটি কবিতায় রুশ ভাষার সম্পদকে রক্ষার অঙ্গীকার করেন।
জালালউদ্দিন রুমি বলেন, “ফারসি ভাষায় সব বলো, একান্ত বাধ্য হলে আরবী ব্যবহার করো।”
“নিজের ভাষায়ই ভালোবাসার প্রকাশ হয়ে থাকে।”, বলেন তিনি।
জাপানি কবি কোউইচি ইজিমা বিদেশে ছয় মাস কাটিয়ে উপলব্ধি করেন, একবারও কবিতা লেখার কথা মনে আসেনি তার। জাপানে ফেরার কয়েক দিনের মাথায় তিনি কবিতা না লিখে থাকতে পারেননি।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলীর জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেন, “শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের দুধের মতো।” বিদেশি কোনো ভাষার বিরোধী ছিলেন না তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় ইংরেজি চলতে পারে বলে মনে করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিদেশি ভাষা ক্ষুদ্র বাতির মতো আলো দিয়ে থাকে। আর নিজেকে প্রকাশে মাতৃভাষা দেয় সকালের সূর্যের দিগন্ত বিস্তারি আলো।
মাত্র কয়েক বছর আগে হং কংয়ের শিক্ষা অধিদপ্তর মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার আগে ইংরেজী মাধ্যমের এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি খুব অসুখী। গত ছয় মাস শ্রেণীকক্ষে কী পড়ানো হয়েছে তা আমি বুঝিনি। আমি কেবল সেখানে বসে থেকেছি আর কষ্ট পেয়েছি। আমি শোনার চেষ্টা করেছি কিন্তু শিক্ষক কী বলেছেন তা আমি বুঝতে পারিনি।”
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঘোষণা দেন ঊর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। তার ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাঙলার মানুষ প্রতিবাদ জানায়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দ্রুতই সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ। শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। পূর্ব পাকিস্তান নামে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়। রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের অনুরোধে ১৯৯৯ ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২৩ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ভাষা। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ছয় হাজার ভাষা বিলুপ্তির হুমকির মুখে আছে। আর অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। বিলুপ্ত প্রায় এসব ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছে ইউনেস্কো।
সংক্ষেপিত ও ভাষান্তর: আজিজ হাসান
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন